কন্যা সন্তান ও পুত্র সন্তানের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কারের নাম করেও আমাদের সমাজে বহাল তবিয়তে চলছে অজস্র ভেদাভেদী!!

শাস্ত্র,ধর্ম,লোকাচার সমাজ,বিধান,বোধহয় এসব কিছু র থেকে অনেকটা বাইরে বেরিয়ে ভাইয়ের সাথে যৌথভাবে করেছিলাম বাবার মুখাগ্নি,গঙ্গায় অস্থি বিসর্জন.. ও একক ভাবে বাবার পিণ্ড দান, শুধুমাত্র আমি আমার বাবার সন্তান বা জ্যেষ্ঠ সন্তান বলেই স্বাভাবিকভাবে,স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমি এইসব কাজগুলো করতে পারি এটা ভেবে।সেখানে কন্যা বা পুত্র সন্তান বলে কোনো মান্ধাত্তা আমলের টিকি ধারী তর্ক রত্নভূষণ কি বিধান লিখে গেছেন সেসবের দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করেই।করতে চেয়েছিলাম বাবার শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ ১৩ দিনে, চার দিনের পরিবর্তে,নিজেকে
গোত্রান্তরিত,বিবাহিত,অবিবাহিত,বিধবা,ডিভোর্সি বা সধবা এইসব ফালতু বিষয়ের তোয়াক্কা না করেই।
কিন্তু ফলশ্রুতি হিসেবে দেখলাম,অদ্ভুতভাবে চারপাশে গড়ে উঠতে শুরু করেছে একটা প্রতিরোধের ঝড়। যেন আমি অনাচারী,স্বেচ্ছাচারী ইত্যাদি ইত্যাদি… আমার বাবার আত্মার শান্তি নিয়ে,তার গঙ্গা প্রাপ্তি নিয়ে দূরবীন দিয়ে দেখা দূরের মানুষগুলোর এত চিন্তা শুরু হয়ে গেল যে সেই তুলনায় আমি নিতান্ত ভুল,অন্যায়কারী বলে চিহ্নিত হতে থাকলাম।কেউ কেউ আবার এটাকে আমার ধৃষ্টতা বলে মনে করে বাবার কাজেই এলেন না। হয়তো এইভাবে আমার সিদ্ধান্তে আমাকে অটল থেকে চার পাঁচ ঘন্টা ধরে বাবার শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ নিজেদের চোখে দেখার মত সহ্য শক্তি তাদের নেই।বদলে গেল পুরোহিত ঠাকুরও,সামান্য একটা অজুহাত তৈরি করে। কি অদ্ভুত!এইসব বিষয় নিয়েও এত খবরদারি হয় কেন? যেখানে খবরদারির বিষয়গুলো খবরদারি করার লোকের অভাবে রাস্তায় গড়াগড়ি যায় ! যাই হোক যার যার যুক্তি তার তার কাছে।

আমার এই সিদ্ধান্তটাকে মন থেকে মানতে পারছিল না কেউই। তাও যদি আমি একমাত্র সন্তান হতাম আমার তো ভাই আছে,তাহলে এই সব সৌখিন আবদার করার মানে কি? সবাই যেটা যুগ যুগ ধরে করে আসছে তার বাইরে গিয়ে হবে টা কি? নিজেকে আধুনিক প্রমাণ করতে চাইছে বোধয়, সবার থেকে আলাদা প্রতিপন্ন করতে চাইছে বোধয়,কত কত মনে হওয়া।হায়রে অভাগা সমাজ।আমার বাবার আত্মার শান্তির জন্য আমার অন্তরের চূড়ান্ত শ্রদ্ধার নির্যাসটুকু আমি কিভাবে অর্পণ করব তা নাকি নির্ধারণ করে দেবে, দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা অনেক দূরের কিছু মানুষজন। আর কিছু পুরোহিত সম্প্রদায়!
যাই হোক শেষে একজন উন্নত মনষ্কের পুরোহিত মশাই এলেন আজকে সকালবেলায়। বুঝতে পারলাম তাঁর কাছেও আমার পরিকল্পনা বা সংকল্পের ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। তাঁকেও সেভাবে ঠিক কেউ বলে দেয়নি। তালেগোলে পুত্র সন্তানেরই দীর্ঘ কাজের বিষয়টাই কায়েম করার চেষ্টা চলছে। তাই বাধ্য হয়েই তাঁকে সরাসরি সবটা জানালাম।তিনি মানলেন আমার কথা। তাই শুরু থেকে প্রায় শেষ অব্দি আমি আর আমার ভাই পাশাপাশি বসে আমাদের বাবা ডক্টর দীপক কুমার বসুর সন্তান হিসেবে তাঁর আত্মার শান্তির জন্য যাবতীয় ক্রিয়াদি সম্পন্ন করলাম।দান সামগ্রীতে বিভিন্ন মূল্যবান বিষয়ের মধ্যে ছিল আমার তরফ থেকে অর্পণ করা আমার বইপ্রেমী বাবার উদ্দেশ্যে,আমার লেখা নারী স্বাধীনতা নিয়ে উপন্যাস “আগুনের পরশমণী”।আমার অনুরোধে ঠাকুর মশাই সেই বইটাকেও দীর্ঘ মন্ত্র উচ্চারণ করে ব্রাহ্মণ দানের এক অভিনব সামগ্রী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ধন্যবাদ তাঁকে।একজন মেয়ে যদি তার পিতা বা মাতার মুখাগ্নি করে,পিন্ড দান করে তাহলেও নাকি তাকে চার দিনেরই কাজ করতে হবে। মানলাম লেখা আছে এটা শাস্ত্রে,হতে পারে তার একটা অন্য কোনো বহু যুগ আগের সাথে মানানসই কারণও আছে। কিন্তু সামাজিকভাবে ভাবলে, বলা যেতেই পারে যে ,১৩ দিন ধরে বিবাহিত মেয়ে যদি তার বাবা-মায়ের জন্য অশৌচ পালন করে,তাহলে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নানান কারণে অনেক অসুবিধা হয়। সেই কারণে সেই মেয়েই যখন অন্যের বাড়ির পুত্রবধূ তখন তার শ্বশুর বা শাশুড়ি মারা গেলে কিন্তু তাকে তার স্বামীর সাথে মনের ইচ্ছে থাকুক আর না থাকুক ১৩ দিনের কাজ ই করতে হয়। তখন তার জন্য এমনই বিধি নিষেধ রয়েছে। কি সুযোগ সন্ধানী না এইসব বিধি নিষেধ গুলো? তাই বলা যেতেই পারে,যে মেয়েকে বিয়ের সময় অন্যান্য আসবাবপত্রের সাথে দান করা হয়,তার ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতার ছাড়পত্র কোনো সমাজই উদারভাবে মেনে নিতে পারেনা। যাই হোক কোনো মহিলাই যে এমন আগে কখনো করেননি, এই প্রথম.. কিছু একটা হল. এসব বোকা বোকা কথা আমি বলছি না। তবে আমাকে যে এইভাবে এই বিষয় নিয়ে এত সব কিছুর সম্মুখীন হতে হবে,সেটা আমি সত্যিই ভাবি নি। যাই হোক আমি যে নিজের সামান্য শিক্ষাটা কে,সামান্যতর ডিগ্রী গুলো কে যুক্তি দিয়ে নিজের বোধ বুদ্ধি অনুযায়ী বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারি,সেটাই এক অদ্ভুত শান্তির কারণ। বাবার পছন্দের যতটা সম্ভব সব পদগুলোই ভাতসরাতে আজ অর্পণ করেছি,নিজে হাতে শেষ বারের মতো বাবার জন্য রেঁধে। সন্তান তার বাবা মার জন্য করবে এটাই স্বাভাবিক,ঠিক যেভাবে বাবা-মা তার সন্তানের জন্য করেন। এখানে না থাকে কোন প্রতিযোগিতার লড়াই।না থাকে কোনো আমি.. আমার বড়াই।না থাকে কোনো নাম কেনার মরিয়া উদ্যোগ। তাই এবার বোধায় সময় এসেছে,সংস্কার গুলোকে শুধু সংস্কার হিসেবেই মানার,কন্যা না পুত্র সন্তান সেই ভেবে মূর্খের অজুহাত দিয়ে,অন্যের জীবনে সেই মূর্খতাকে জোর জবরদস্তি আরোপ বন্ধ করার।