“পরকীয়া”
কলমে সোনালী
সমাজে একটা বহুল প্রচলিত শব্দ বা আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এখন পরকীয়া। আগেও ছিল,তবে পার্থক্য শুধু এটাই এখন হয়তো বিষয়টা লুকোচুরি, আড়াল আবডালের থেকে বেরিয়ে,অনেকটাই বেপরোয়া রূপে আত্মপ্রকাশ করছে,যেটা কোন কোন ক্ষেত্রে শালীনতার মাত্রাকে খর্বিত করছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে চারপাশের সমাজ-পরিবেশের ওপর তার একটা ভালো মতন প্রভাবও ফেলছে,যা অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই মেনে নেওয়াটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই এমা! ওমা! সেকি! একি! ছি ছি! এরকম অনেক রকমের বিস্ময় বোধক চিহ্নের দ্বারা নির্ধারিত হচ্ছেন,কিছু মানুষ এবং তাদের সম্পর্কের সমীকরণ।
আমি জানিনা কেন,হঠাৎ করে ই আমার এই ‘পরকীয়া’ শব্দটাকে একটু হিন্দিতে উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করছে।পরকীয়া,মতলব আপনোকো ঠুক্রাকে, ইয়া আপনোকে সাথ না করকে দুসরে কিসিকে সাথ কিয়া,পর সে কিয়া।এবার বিষয় হচ্ছে,আমি কি পরকীয়াকে সমর্থন করছি?উত্তর হল ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধিতাও করছি না।আর এর স্বপক্ষে আমি যথেষ্ট যুক্তিও দেব এই আর্টিকেলটাতে।এবং কিছু প্রশ্নও রাখবো পাঠকদের উদ্দেশ্যে। তবে হ্যাঁ কেউ ভাবতেই পারেন,আমি কোথাকার কে হরিদাসিনী পাল যে,এই বিষয়টি নিয়ে নিজের মতামত সবার সামনে তুলে ধরতে চাইছি,সমাজের এত হর্তা-কর্তা,দন্ডমুন্ডের অধিকর্তা রা থাকতে?এর উত্তরে আমি বলব,আমি একজন সচেতন নাগরিক।আর এই গণতান্ত্রিক দেশে আমার অধিকার আছে,অপরের স্বার্থকে ক্ষুন্ন না করে,যুক্তিসঙ্গত ভাবে,কোন বিষয়ের বহু চর্চিত একঘেয়ে দিকগুলো ছাড়াও,তার অন্য কোন ডায়মেনশনাল দিক নিয়ে,আলোচনা করা।বিচার বিশ্লেষণ করা। যাতে এর থেকে ভবিষ্যতে সামান্য পরিমাণ হলেও,কোন নতুন দিক উঠে আসতে পারে।

তাই এ ক্ষেত্রে আমার মতামত কজনের দ্বারা স্বীকৃত হল বা ধিকৃত হলো,বা বিকৃত হল,সে নিয়ে না ভেবেই আমার মনে হওয়া গুলো শেয়ার করছি। কাউকে অজান্তে যদি এর জন্য,কোনোভাবে আঘাত দিয়ে ফেলি,তার জন্য আমি দুঃখিত।

আর একটা কথা উল্লেখ করে দেওয়া খুবই প্রয়োজন যে,দয়া করে আমার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করে,আমাকে নারীবাদ বা পুরুষবাদ বা আতঙ্কবাদ এইসব কোন একটার পর্যায়ে ফেলে,অহেতুক বিবাদে সামিল করবেন না। কারণ,আমি এইসব শব্দের পেছনে উঁচিয়ে থাকা কোন রকমের বাদ বিবাদে ই বিশ্বাসী নই। একমাত্র মানবতাবাদ ছাড়া।আসুন এবার মূল বিষয়টাতে ঢোকা যাক।

কোন ডাক্তারের কাছে কুড়ি জন জ্বরের রোগী এলে, তিনি যেমন কোন সার্বজনীন চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন না কারণ, একেক জনের ক্ষেত্রে জ্বরের কারণ একেক রকম হতে পারে। ম্যালেরিয়া,টাইফয়েড,ডেঙ্গু,ভাইরাল ইনফেকশন,ঠান্ডা লাগা,আবার কোনো ক্ষেত্রে হয়তো শুধুমাত্র এক্সাম ফিয়ার।

ঠিক তেমন ই কেউ খুন হলেও মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করে,তবেই মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করা হয়। এবং সেই অনুযায়ী খুনিকে শাস্তি দেওয়া হয়।

ঠিক তেমনভাবেই কোন পুরুষ বা মহিলার জীবনেও বিবাহ বহির্ভূত কোন সম্পর্কের অভ্যুত্থান হলে,তার একটা কেস হিস্ট্রিও অবশ্যই থাকবে।যেটা কখনো তাদের লাম্পট্যের বিষয়কেও প্রকাশ করতে পারে,আবার কখনো তাদের ওপর হওয়া অমানবিক ভায়োলেসনের দিকটাতেও আলোকপাত করতে পারে। তাই বাইরে থেকে ঘটনাগুলো একরকম দেখালেও,প্রত্যেকটা বিষয় ই কিন্তু ভেতর থেকে এক রকম হয়না। অথচ আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই,এই ধরনের ঘটনাগুলোকে,আমাদের চেনা পরিচিত কোন একটা খাপের মধ্যে জোর,জার করে,ঢুকিয়ে দিয়ে,ছি ছিক্কারের কালি মাখিয়ে,তাদেরকে লোভী,ব্যাভিচারী বা ব্যভিচারিণী ইত্যাদি ইত্যাদি তকমায় চিহ্নিত করে আনন্দ পাই। বা নিজেদেরকে সমাজ সংস্কারক ভেবে গর্ব বোধ করি। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না যে,কোন সার্বজনীন ব্যবস্থা বা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হলে,আমাদের কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। যদিও আমরা বেশিরভাগ মানুষই কোন স্বচ্ছ ধারণার থেকে,চটুল, রসালো,অসচ্ছ ধারণাকেই চটজলদি গ্রহণ করে নিয়ে,সমালোচনার ঝড় তুলতেই বেশি আগ্রহী হই।

যেন কোন বীক্ষনাগারের তীক্ষ্ণ আলোক রশ্মি আমাদের ওপর দিয়ে অতিবাহিত হলে,আমাদের সর্ব শরীর এবং মস্তিষ্কের কোষ থেকে যে,অনু পরমানু নির্গত হবে, তার থেকে ঠিকরে বেরোবে,একটাই কথা,আমরা সৎ।একমাত্র আমরাই সৎ।

যদিও সমাজের পরিকাঠামো রক্ষা করার দায়ে এবং সমাজকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করার তাগিদে,বা পরিবার পরিকাঠামো কে বাঁচানোর মহৎ উদ্দেশ্যে আমরা,অবৈধ এবং অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উৎসাহিত হই, একজন সঠিক নাগরিক হিসেবে।কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ কিছু বিষয় খুঁটিয়ে দেখাও অত্যন্ত প্রয়োজন।কারণ সমালোচনা যদি করব,অগণিত অকথা, কুকথাও যখন বলব,কোন না কোন ভাবে কিছু মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করব,এবং কিছুটা পরিমাণে বিপর্যস্তও করব,তখন কিছুটা দায়ভারও তো বহন করতে হবে যে,এই সবকিছু যথা স্থানেই করছি কিনা? কারণ শুধুমাত্র কোন কিছু আরোপ করে দেওয়া বা ফরমান জারি করে দেওয়া,কোন প্রগতিশীল সমাজের সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে না। সেখানে গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে তার একটা সুক্ষ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও অবশ্যই থাকবে যেটাকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।আর যেহেতু,প্রত্যেকটি বিষয় কোন না কোন কার্যকারণ সম্পর্কের ফলশ্রুতি,তাই এক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণও থাকবে। তা পজিটিভ ই হোক বা নেগেটিভ ই হোক।

যদিও কিছু মানুষজন,সমাজকে এই বিষয়ে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে যান,কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি প্রশ্ন কিন্তু ঠিকই থেকে যায়। যার উত্তর খোঁজা একান্ত প্রয়োজন।

1. যার ক্ষেত্রে,নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই অভিযোগটি উঠেছে,তার পেডিগ্রি টা ঠিক কি?অর্থাৎ সংসার ভেঙে,সঙ্গি বা সঙ্গীনিটিকে ঠকিয়ে,সমাজকে কলা দেখিয়ে বিরাট কিছু ঘটিয়ে ফেলা মানুষটির নিশ্চয়ই স্কুল,কলেজ,university,বড় হয়ে ওঠার পাড়া এই সমস্ত জায়গাতেও এমন কিছু করে বেড়ানোর,নমুনা থাকবে।কারণ এই সমস্ত পর্বে অত্যন্ত সংযত থাকা কোন মানুষ,বিনা কারণে শুধুমাত্র খেয়ালের বসে,শারীরিক সুখের লোভে বা আর্থিক লালসার বশবর্তী হয়ে,এত কিছু ঘটাবেন না এত বড় বড় পদক্ষেপ নেবেন না।

2. পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার আগে,তার সাংসারিক জীবনের মেয়াদ কত বছর ছিল?এবং এই মেয়াদকালীন অবস্থায়, তার দায় দায়িত্ববোধ ঠিক কতটা ছিল বা ছিল না,এছাড়াও তিনি এই ধরনের মন মানসিকতার প্রতিফলন কতবার,কার কার ক্ষেত্রে কি,কি ভাবে ঘটিয়েছেন?

3. সেই পুরুষটির বা নারীটির বিবাহিত জীবনের নমুনা বা দাম্পত্য সম্পর্কের সমীকরণটা ঠিক কেমন ছিল? অর্থাৎ সুখে,ভোগে,ভালোবাসায়,যত্নে তার জীবন কাটছিল কি?এবং তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সুখে থাকতে ভুতে কেলালো বলেই,সে বিশ্বাসঘাতক বা বিশ্বাসঘাতকিনী হয়ে,সবকিছু বিনা কারণে নিজে থেকেই ভেঙে দিয়ে,ক্ষণিক ফুর্তির লোভে,এত কিছু ঘটিয়ে ফেলেছেন ?

4. ইনভেস্টিগেশন বা তদন্ত করে দেখা যে,আত্মপক্ষ সমর্থনের কারণেই কি সে, দিনকে রাত, রাতকে দিন করে,পরকীয়ার কারণটা কে,মিথ্যে, অবান্তর কিছু সেন্টিমেন্টাল অজুহাত দিয়ে,নিজেকে জাস্টিফাইড করার চেষ্টা করছে? নাকি সত্যি,সত্যিই তাদের বিবাহিত জীবনে ভুরি,ভুরি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের নজীর আছে?আছে, অপমান,অবমাননা,আতঙ্ক,মানসিক ক্রাইসিস, একজিসটেন্স ক্রাইসিস?

5. লোকাল থানা এইসব বিষয়ে অবগত ছিল কি? থাকলে কিভাবে ছিল?কতবার জিডি হয়েছে? হলে তার বিষয়বস্তু কি ছিল?কেন লিগাল অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে কোন কিছু এক্সিকিউট করা হয় নি? জিডিগুলো কিছুদিনের মধ্যেই উইথড্র করা হয়েছিল কি?সেখানে কি কারণ দেখানো হয়েছিল? সংসার বাঁচানো গাছের কিছু ? লোক লজ্জার ভয় ?কোন একদিন সবটা ঠিক হয়ে যাবে,সন্তান-সন্ততীর মুখের দিকে তাকিয়ে,এমন কোন কারণ ? যদি তা হয়ে থাকে, তবে কারা উইথড্র করেছিলেন? অভিভাবক অভিভাবিকারা? নাকি অভিযোগকারীনি বা অভিযোগকারী নিজেই?

6. বাড়িতে কোনদিন এইসব কারণে,পুলিশ হানা দিয়েছিল কি?দিলে তার কারণ কি ছিল?

7. ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে, কি? কি এলিগেশন ঘুরেফিরে বারবার সামনে এসেছে?এবং সেই ভায়োলেসন থেকে বাঁচার জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ?এবং তা কেন জোরালো ভাবে
প্রতিকার দিতে পারিনি?পারলে কি কি অ্যাকশন নেওয়া হয়েছিল?

8. বারবার খালি জি.ডি.ই করা হয়েছে কেন ? ৪৯৮ করা হয়নি কেন? ছোবল না মেরে শুধু ফোঁস টুকু করার জন্য? কিন্তু এর ফলশ্রুতি কি হয়েছিল?

9. বিবাহিত জীবনে আর্থিক এবং সামাজিক স্বাধীনতা এবং সম্মান বজায় ছিল কি? অবহেলা এবং অসম্মান কি কি ভাবে করা হত? ফাঁকা ঘরে? না কি সবার সামনে?

10. মহিলা বা পুরুষটি কি সবসময়,হাসিখুশি ভাবে তার জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সাথে সময় অতিবাহিত করতেন?কাছে দূরে কোথাও বেড়াতে গিয়ে, নিজেদের জীবনের মুহূর্তগুলোকে সুন্দর করে তোলার উদ্যোগ নিতেন?

11.মহিলাটি বা পুরুষটি একে অপরের বিরুদ্ধে ঠিক কি ধরনের অভিযোগ আনতেন?শারীরিক নির্যাতন? সেক্সুয়াল নির্যাতন? সামাজিক অবমাননা জনিত নির্যাতন?ভারবাল অ্যাবুউস?মেন্টাল প্রমাণ করার চেষ্টা? কনফিডেন্স বা আত্মবিশ্বাসকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে,ধীরে ধীরে অসুস্থ বানিয়ে লোকের সামনে উপস্থাপন করার প্রয়াস? হুমকি? কি ছিল? বা আদৌ ছিল কিনা?

12. একে অপরের পরিবারের বিভিন্ন সদস্য ও সদস্যাদের প্রতি কি ধরনের অভিযোগ করতেন?সম্পত্তি জনিত কোন অভিযোগ?শশুর শাশুড়ির দায়-দায়িত্ব বহন জনিত কোন অশান্তি?সংসারে অষ্টপ্রহর কোন বিবাহিত বা অবিবাহিত ননদ বা একাধিক শাশুড়ি বা এই ধরনের কিছু মানুষের কার্যকলাপে অতিষ্ট হয়ে যাওয়া? সন্তান হীনতা জনিত কোন কারণ? সেক্সুয়াল স্যাটিস্ফেক্শানের অভাবজনিত কোন অভিযোগ?এক্সপেন্সিভ জিনিস পত্রের দাবি?

13. নাকি একে অপরের জন্য গুরুত্ব,ভালোবাসা,সময় এসব কিছু না দিতে পারা জনিত কোন ইমোশনাল ক্রাইসিস?

14. এইসব অভিযোগের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কি কি সাক্ষী বা প্রমাণ আছে?এইসব বিষয়গুলো খুঁটিয়ে দেখতে পারব তো আমরা? পারব না বললে তো হবে না, কারণ অভিযোগের আঙুল যদি তুলতে পারব,কাঠগড়ায় যদি দাঁড় করাতে পারব,মজা তামাশা যদি লুটতে পারব,তাহলে সেই সংক্রান্ত ঠিক ভুলের পরখ করতে পারবনা কেন ?পারতে তো হবেই ,কারণ পরকীয়া জনিত রসালো আলাপ আলোচনা,নোংরা মন্তব্য,ভর্ৎসনা অনেকের ব্যক্তিত্ব বা অস্তিত্বকে শুধু ঘেঁটেই দেয়না,তাদের সন্তান সন্তুতিদের জীবনেও গুরুতর প্রভাব ফেলে। যা হয়তো তারা ডিজার্ভ করে না। তাই এই ক্ষেত্রে বিষয়গুলোর পোস্টমর্টেম হওয়া অত্যন্ত জরুরী।

আপনারা বলবেন বা আমরা বলব সে আবার কি করে সম্ভব ?আমরা কি খরচা করে,লোকজন লাগিয়ে এখন কার বাড়িতে কোন সময় কি হয়েছিল?কতটা হয়েছিল?সেসব দেখতে যাব নাকি? ঠিকই বলেছেন।আমরা এসব কিছুই দেখতে যাব না।কারণ তখন আমাদের সামাজিক পরিকাঠামো নিয়ে, বা তা রক্ষা করা নিয়ে কোনো দায়বদ্ধতার বোধ কাজ করেনা। তাই বিরাট বিরাট রক্তহীম করা ভায়োলিশনকেও গা বাঁচানো হাসি হেসে,সামান্য দাম্পত্য কলহ বলে সরে পড়ি বা উপেক্ষা করি আমরা। মানে এ যেন,সমাজ স্বীকৃত অত্যাচার করার লাইসেন্স। তাই তখন আমাদের বিশেষ মাথা ব্যথা থাকে না।আমাদের মাথা ব্যথা শুরু হয় ঠিক সেই পর্যায় থেকে,যখন পোচে,পোচে অবহেলিত হওয়ার বদলে চিত্রটা পাল্টে যায়। এই বদলটাই আমরা তখন মানতে পারি না। অথচ বদলের পেছনের কারণটাও জানার কোন প্রয়োজন বোধ করি না। সবাইকেই তাই এক মিলে তৈরি হওয়া ছিটের কাপড়ের মত বা কলের পুতুলের মত ভেবে নিয়ে,লেবেল সেটে দিয়ে আত্মতুষ্টি খুঁজি। কিন্তু সমাজকে নিয়ে এইভাবে সচেতন থাকা,আমরা,কিন্তু ভুলে যাই যে,আমাদের এই আচার-আচরণও কিন্তু সমাজের ইনফ্রাস্ট্রাকচারকে হিলিয়ে দিতে পারে।

এই ক্ষেত্রে বিখ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা “সতী” কবিতাটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে,যেখানে একটি সদ্য বিধবা কিশোরীকে,সগ্গে পাঠানোর তোড়জোড়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রায় আধমরা করে,চিতার আগুনে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে আর এই মহান দৃশ্য দেখে পূন্য অর্জনের নামে,চলছে,উন্মাদনা।আর ঠিক তখনই  বজ্রবিদ্যুৎ সহ,বৃষ্টির অতর্কিত আগমনে, চারপাশের লোকজন নিজেদেরকে বাঁচাতে,যে যার মত করে দৌড়ে পালায় আর অন্যদিকে বৃষ্টির জলে নিভে যায় চিতার আগুনও।

আর সেই অবকাশে প্রচন্ড দাবদাহের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে,আধ জ্বলা অবস্থাতেই কিশোরী বা যুবতী টিও তার সবটুকু শক্তি দিয়ে,কোনোরকমে সেখান থেকে হুড়মুড় করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে নদীতে।যেখানে তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়,এক বেধর্মী মাঝি। এবং ধীরে,ধীরে এই পোড়ামুখী,পোড়া শরীরের মেয়ে টিই, হয়ে ওঠে, ওই মাঝির কুঁড়েঘরের একমাত্র ভালবাসার উৎস।

আচ্ছা কবি নিশ্চয়ই এমনি,এমনি লেখেননি কবিতাটি। যথেষ্ট সমাজ সচেতন হয়েই লিখেছিলেন,দিতে চেয়েছিলেন এক মহান বার্তা। যা সেকাল-একাল সর্বকালের গণ্ডিকে অতিক্রম করে,চিরন্তন এক সর্বজনীন আবেদনের দাবিদার হয়ে উঠেছে । যেখানে তাদের এই নিঃস্বার্থ প্রেম ,ভালোবাসার সম্পর্কটা নিশ্চয়ই আর কোন অবৈধ বা অসামাজিকতার আওতায় পড়ে না। ফলে এই বিষয়টার মনস্তত্ত্ব টা নিশ্চয়ই খুব পরিষ্কার আমাদের সকলের কাছে। অর্থাৎ কাউকে জীবনের কিনারে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়ার সব রকম ষোল কলা পূর্ণ করার পর,সে উত্তর মুখো হয়ে নিচে পড়বে? না দক্ষিণ মুখো হয়ে নিচে পড়বে? ওডিসির মুদ্রায় পড়বে? নাকি ভরতনাট্যম বা কথাকলির মুদ্রায় পড়বে ? সেটা কি আর সমাজের বা তার পরিবারের লোকজনের আলোচনার আওতায় পড়তে পারে ? না পড়া উচিত ? না কি তখনও কারোর চারিত্রিক বিষয় নিয়ে কাঁটাছেড়া করার একচেটিয়া স্পর্ধা বা অধিকার থেকে যায় আমাদের ??

কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বিশেষ একটি উপন্যাসের কয়েকটি লাইন মনে পড়ে গেল I মানুষের মন নদীর স্রোতের মতো। তাকে রক্ত চক্ষু অনুশাসনে বেঁধে,ছেঁদে আটকে রাখলে তা,পোকা মাকড়ে ভর্তি একটা পচা,স্রোতহীন ডোবায় পরিণত হয়।

বিয়ে আমাদের সমাজে একটা অত্যন্ত প্রাচীন,সমীচীন ইনস্টিটিউশন। সে নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তার প্রচুর ভালো দিক আছে আমাদের সমাজে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কয়েকটি কথা অবশ্যই বলব যে,কারোর সাথে কারোর একবার বিয়ে হয়ে গেছে বলেই, সারা জীবন ধরে সেই মানুষটিকে নানান কারণে মেনে নিতে না পারা সত্বেও,কখনো বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে,কখনো মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে,কখনো ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, কখনো আত্মীয় পরিজন,সমাজের মুখের দিকে তাকিয়ে,আর কখনো সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে, একমাত্র নিজের মুখের দিকে কখনো না তাকিয়ে, কোনরকমে কাটিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোন মহত্ত্ব বা কৃতিত্ব নেই। আছে শুধু একরাশ অপদার্থতা। যা কারো কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও অনেকের ক্ষেত্রেই নয়।

হতেই পারে কোন মহিলার হয়তো মাতাল বা মদ্যাসক্ত ব্যক্তিকে একেবারেই পছন্দ নয়।
কিন্তু ঘটনাক্রমে,দুর্ভাগ্যজনিত কারণে তার এমনই একজন ব্যক্তির সাথে বিয়ে হয়ে গেছে এবং বিবাহ পরবর্তীকালে তিনি তার মদ্যপ অবস্থায় থাকাকালীন স্বামীর,আচার-আচরণের দায়ভার কিছুতেই বহন করতে পারছেন না। মানিয়ে নিতে পারছেন না।সে ক্ষেত্রে মহিলাটির কি করা উচিত ? কি রায় দেবে আমাদের সমাজ? পরিবার পরিজন?মানিয়ে নে,একদিন মাতাল মদ খাওয়া ছেড়ে দেবে? কোন একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। রোজগার পাতি ভালো করে,বেশ কিছু ডিগ্রি আছে,অবস্থা ভালো তাই ওই সামান্য বিষয়টুকু ইগনোর করে মানিয়ে নে?

বা ধরুন বিয়ের পরে আবিষ্কার হলো কারো স্ত্রী অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত বা কারো স্বামী, সে ক্ষেত্রে কি হওয়া উচিত? ও আমার স্বামী তো? দু একটা নয় ধর্ষণ বা খুন করেই ফেলেছে, বা আমার বউ তো, কয়েকটা রাত নয় কয়েকজন পুরুষের সাথে বিছানায় কাটিয়েই ফেলেছে। এরকম বল্লেই কি পার পেয়ে যাবেন তারা? আপনি মানিয়ে নিচ্ছেন বলেই আইন আদালত ছেড়ে দেবে তাদের এটা কোনদিন হয়? কারণ অপরাধ আর অপরাধী তা সে যে সম্পর্কের ই হোক না কেন অপরাধ ই হয়।সে ক্ষেত্রে মানিয়ে নেওয়ার কথা আসেনা। মানিয়ে নেওয়ার কথা আসে তখন যদি স্বামীর অ্যাক্সিডেন্টে পা চলে যায়,তিনি সেভাবে রোজগারে আর সক্ষম থাকেন না। তখন কি করবে তার সঙ্গিনীটি?অন্য কোন সক্ষম পুরুষকে পাকরিয়ে সেখান থেকে সরে পড়বেন? নিশ্চয়ই না। সেখানে তিনি মানিয়ে নেবেন। এটাই তার ধর্ম এটাই তার সংস্কারের পরিচয় হবে। তাই কোনটা সওয়া আর কোনটা ক্ষওয়া সে বিষয়ে ধারণা থাকা দরকার। কারণ সহিষ্ণুতা আর ক্ষয়িষ্ণতা কিন্তু সমার্থক নয়। তাই নিজের নাম ক্ষয় রোগের প্রতিযোগিতায় লিখিয়ে,প্রতিদিন ফুরিয়ে যাওয়ার মধ্যে কিছুই হাসিল হয় না। যতই অনেকে এই বিষয়ে বড় বড় উপদেশ দিন না কেন।

তাই আমার মনে হয়, দুটি মানুষ যদি মনে করেন যে, অনেকগুলো কারণে কোনোভাবেই তাদের পক্ষে একসাথে সুখে,ভোগে থাকা সম্ভব নয়,সে ক্ষেত্রে হতাশা গ্রস্ত,বিপর্যস্ত একটা অবাঞ্ছিত সম্পর্ককেও,ঘাড়ে করে টেনে নিয়ে যেতে হবে,শুধুমাত্র লোকে ভালো বলবে এই সার্টিফিকেট এর আশায়? তাহলে সেটা বিরাট বড় ভুল হবে।

বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন যা প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সমাজের মধ্যে নিজের ধনাত্মক দিকগুলোকে কায়েম করেছে। কিন্তু আমরা কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থে সেটাকে বিকৃত করে যদি তাকে,ইঁদুর মারার কলের মতো একটা কনসেপশানে নিয়ে যাই,যেখানে একবার ঢুকলে আর বেরোনোর পথ থাকবে না, কোন না কোন ভাবে মানাতে হবে বা নিঃশেষিত হয়ে যেতে হবে,তাহলে এর থেকে বড় ট্রাজেডি আর কিছু হতে পারে না। আর সেখান থেকেই সূত্রপাত হয় তৃতীয় কোন ব্যক্তির অনুপ্রবেশ জনিত কারণের কমপ্লিকেশন। তার থেকে বরং এইসব ঘটার আগেই আইনের সাহায্য নিয়ে দুজন দুজনের থেকে ভদ্রস্ত ভাবে সরে আসাটাই দুপক্ষের কাছে সম্মানজনক। কারণ জোর জবরদস্তি করে অধিকারের দোহাই দিয়ে,কাঁদুনি গেয়ে, চমকানি ধমকানি দিয়ে কোন সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। আর এর পরিণতিও ভালো হয় না। কারণ ক্লান্তিকর দুর্বিষহ জীবনে র থেকে মানুষ এক না একদিন মুক্তি খুজবেই আর তখনই হবে ভয়ংকর অপরাধ। তবে হ্যাঁ অনেক ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক বিষয়টা একটা বড় প্রতিবন্ধকতার জায়গা তৈরি করে। সেই বিষয়টাকে এড়িয়ে না গিয়ে যদি যথাযথভাবে সমাধান করা যায় আর তখন যদি, কোনো পক্ষ সরাসরি অপরপক্ষের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে,কিন্তু তার পরেও যদি অপরদিকের মানুষটি অসহায় ওতা জনিত কারণে বা অন্য যেকোনো কারণেই সেই মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে এই কঙ্কালসার সম্পর্কটাকেই আঁকড়ে থাকতে চায় বা বহন করতে চায় কোন না কোন অজুহাতে তাহলে আর উল্টো দিকের লোকটার তেমনভাবে কোন দায়বদ্ধতা থাকার কথা নয়। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বোধহয় আমরা সমাজ মোড়ল বা সমাজপতি হয়ে, কাউকে ঘেঁটি ধরে, ঝুঁটি ধরে, কলার ধরে, চরথাপ্পড় মেরে বাধ্য করতে পারি না আমাদের বাতলে দেওয়া খড়ি মাটি দিয়ে নির্ধারিত করে দেওয়া,সংকীর্ণ কোন গণ্ডির মধ্যে তার সম্পূর্ণ জীবনটাকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য। না পারিনা।