“পরিচয়”
সোনালী মিত্র
অধ্যাপক আদিত্য চৌধুরী কলকাতার একটি স্বনামধন্য কলেজে পদার্থবিদ্যার হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট। শুধু তার কলেজেই নয়,সারা কলকাতা শহরের যে কোন কলেজের ছাত্র-ছাত্রী,শিক্ষক শিক্ষিকা,কলেজের অধ্যাপক অধ্যাপিকারাই তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন তাঁর বিনীত আচরণ,অসাধারণ শিক্ষাগত যোগ্যতা,অতুলনীয় রেজাল্ট ইত্যাদি নানা কারণের জন্য।
এই আদিত্য চৌধুরীর এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের নাম শোধন আর মেয়ের নাম বন্যা। শোধন ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র আর বন্যা ইংরেজিতে এমএ করছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অধ্যাপক চৌধুরীর স্ত্রী যুথিকা,একটু শান্ত শিষ্ট স্বভাবের মানুষ। তিনি বিএসসি পাশ করার পর সংসার ছাড়া আর কোনো দিকেই আগ্রহী হননি। সকলের প্রতি দায়িত্ব,কর্তব্য পালনে তার একটা আলাদাই আন্তরিকতা আছে। তাই শাশুড়ি লতিকা দেবীও ওনাকে বেশ পছন্দ করেন। তবে বন্যাকে সামলাতে গিয়ে উনি প্রায়ই হিমশিম খান। ছোটবেলা থেকেই বন্যা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারীনী। যেমন সুন্দর গানের গলা তার,তেমনি লেখালেখির হাত,তেমনি আবার ছবি আঁকার দক্ষতা,নৃত্যেও পটিয়সী সে। তাই সব মিলিয়ে বন্যার এই দামাল,আধিপত্য বিস্তারকারী স্বভাবের জন্য তার কাছে চারপাশের আর সবাইকে খুব ফিকে বা দুর্বল বলে মনে হয়। এর ওপর বন্যা আবার দেখতেও বেশ সুন্দরী। একেবারে যেন দেব কন্যা। গায়ের রং,কাঁচা হলুদের মত,নাক টিকালো,ভুরু দুটি ধনুকের মতো বাঁকা,টানা টানা উজ্জ্বল একজোড়া চোখ। সব মিলিয়ে এক বিরল সৌন্দর্যের অধিকারিনী সে,যা সচরাচর খুব একটা নজরে পড়ে না কারোর।
ছোটবেলা থেকেই সে অনর্গল কথা বলতে ভালোবাসে,সবকিছুর প্রতিই ওর একটা দুর্বার আগ্রহ আছে। হাসিখুশি,প্রাণবন্ত স্বভাবের বন্যার মুখখানা এতটাই নিষ্পাপ যে,দেখলেই বোঝা যায়,এখনো সমাজের কোনো দূষণ বা ভেজাল মেশেনি তার মনে। সে ফুলের মতই পবিত্র,ধূপের মতই সুরভিত। তাই কোন কিছুর প্রতিই তার কোন লোভও নেই। সে তার যেকোন জিনিসই অন্যের প্রয়োজনে হেলায় দিয়ে দিতে পারে। তাই ছোটবেলা থেকেই সে তার জামা,গল্পের বই, চুলের ফিতে,চকলেট সব কিছুই একে ওকে দিয়ে দেয় অনায়াসেই কারণ কারোর থেকে কিছু নেওয়ার চেয়ে দেওয়ার আনন্দই ওর কাছে চিরকাল বেশি। তাই ঠাকুমা লতিকা দেবী সব সময় চোখে চোখে রাখেন বন্যাকে। বন্যার যাতে কেউ কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেই বিষয়ে তিনি খুব সচেতন থাকেন কারণ তিনি মনে করেন যে,ওনার এই নাতনী টি একটি কোহিনুর হীরে যাকে অনেক ভাগ্য করে তবেই পাওয়া যায়।
বন্যার স্বভাবের আরেকটা দিকও আছে যা সবাইকে বিস্মিত করে। সে জন্ম থেকেই অসম্ভব শিব ভক্ত। শিবকে নিয়ে তার বাড়াবাড়ি রকমের একটা অধিকারবোধ আছে। তাই মাঝে মাঝেই কুমোরটুলি থেকে মাটি এনে সে নিজের হাতেই শিব গড়ে,তারপর ফুল বেলপাতা,ধূপ ধুনো দিয়ে পূজো করে। সন্ধ্যেবেলায়ও পড়তে বসার আগে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে সে শিবের নাম জপ করে।
বন্যাকে কিন্তু এসব করতে কেউ কোনোদিন শেখাননি। মা যুথিকার মধ্যেও বন্যার এইসব স্বভাবের কোনটাই লক্ষ্য করা যায় না। বাবা আদিত্য চৌধুরী প্রচন্ড উন্নত মানসিকতার,পরোপকারী স্বভাবের মানুষ হলেও বন্যার চরিত্রের এই বিশালতা তার মধ্যেও সেই ভাবে ধরা পড়ে না। বন্যা যেন প্রকৃতির মানসকন্যা। বাঁধভাঙা নদীর এক উত্তাল ঢেউ,যাকে আটকে রাখা,সামলে রাখা খুব একটা সহজ কাজ না। তবে বন্যা কখনোই এমন কোন কাজ করে না,যাতে তার বা তার পরিবারের কারোর এতটুকুও সম্মানহানি হয়।
তবে একদিন বন্যার ওপর শোধনের খুব রাগ হয় কারণ বন্যার জন্যই তার ময়না পাখিটা কাঁচা খুলে আকাশে উড়ে গেছে। স্কুল থেকে ফিরে শূণ্য খাঁচা টা দেখে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা তাই সে বন্যাকে বলে ” দি ভাই তুই বড্ড বাজে সেই জন্যেই তুই আমার সাধের পাখিটাকে এইভাবে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারলি” কিন্তু বন্যা এর উত্তরে শোধনকে বলে, “তুই খালি তোর শখের কথাটাই ভাবছিস,ও আকাশের পাখি তাই ভগবান ওকে দুটো ডানা দিয়েছেন আকাশে ওড়ার জন্য। খাঁচার মধ্যে বন্দি থেকে আমাদের মজা দিয়ে তিলে, তিলে মরার জন্য নয়।”
কিন্তু বন্যার মুখে এইসব মহান মহান কথা শুনতে একেবারেই ভালো লাগেনা শোধনের। তাই সে বলে “আমি তোর সাথে আর কোনদিনও কথা বলবো না।” কিন্তু বন্যাকে ছাড়া কারোর পক্ষেই বেশিদিন থাকা সম্ভব না তাই কিছু দিনের মধ্যেই সবকিছু ভুলে যায় শোধন। আর ওদের এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে খুব মজা পান ঠাকুমা লতিকা দেবী।
১২ই জুলাই শনিবার,বন্যা দুপুরের খাওয়া সেরে ওর শরীরটা ভালো না থাকার জন্য,ঠাকুমা লতিকা দেবীর খাটেই ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওর ঘুমটা ভেঙে গেলে ও শুনতে পায় যে, ওর ছোটকা ওর ঠাকুমাকে কোন এক সন্ন্যাসিনী সম্পর্কে কিছু কথা বলছে। যাকে কাজের সূত্রে হরিদ্বারে গিয়ে সে গঙ্গার ঘাটে দেখেছে। যিনি ছোটকা কে দেখেও,ওর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকেও কোন কথা না বলেই সেখান থেকে ধীরে ধীরে চলে গেছেন। যা, শুনে ওর ঠাকুমা বলেন,”মন খারাপ করিসনা টুবাই ও তো আর সাধারণ মানুষ না ও দেবী। সাক্ষাৎ মা সরস্বতী। ওকে ধরে রাখবে এমন ক্ষমতা এই সংসারে কারোর নেই বাবা কিন্তু আমার ভয় অন্যখানে। আমি তো ওকে বেঁধে রাখতে পারিনি। আমি বন্যাকে আগলে রাখতে পারবো তো?ও যে অবিকল তারই মত। ওই রূপ,ওই গুণ,ওই স্বভাব এত মিল দুজনের, কে জানে কি আছে আমাদের কপালে।” বন্যা চুপচাপ শুয়ে এই সব কথা শোনে আর খুব অবাক হয়ে ভাবে কে ওই সন্ন্যাসিনী ?যার সাথে ওর এত মিল? আর তিনি এই পরিবারেরই বা কে হন? কেন তার ঠাকুমা তাকে এতটা ভালোবাসেন? আর কেনই বা ঠাকুমা ওনার মত বন্যাকে হারিয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছেন? ওনার সাথে বন্যার কি সম্পর্ক? বন্যা পরের দিনই প্রচন্ড কৌতূহল নিয়ে ওর ঠাকুমার কাছে জানতে চায়,
” উনি কে?” বন্যার হঠাৎ করে করা এই প্রশ্নতে ওর ঠাকুমা একেবারে হক চকিয়ে যান এবং তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দেন কিন্তু কিছুদিন পরেই বন্যা ওর ঠামুর সুটকেসে ওর বাবার সাথে একজন সুন্দরী মহিলার ছবি দেখে, যে একেবারে ওর মতই দেখতে।
এবার বন্যার ব্যাপারটা অন্যরকম লাগে। তাই সে একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে পরে,সেই ভদ্র মহিলার পরিচয় জানার জন্য। তখন বন্যার জেদের কাছে হার মানতেই হয় লতিকা দেবীকে। তাই তিনি বন্যার হাত ধরে ওকে টানতে টানতে ঠাকুর ঘরে নিয়ে যান আর ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বন্যার হাতটা শিবের মূর্তির ওপর রেখে বন্যার থেকে কথা চান যে,উনি এখন বন্যাকে যে প্রসঙ্গে কথা বলবেন,বন্যা যেন কোনদিনও তা নিয়ে কাউকে কিছু না বলে কারণ এতে কারোর ভালো হবে না। বন্যা ওর ঠাকুমাকে কথা দেয়।
এরপর লতিকা দেবী বন্যাকে বলতে শুরু করেন ওর অজ্ঞাত ইতিহাস।
ওর বাবা আদিত্য এমএসসি পাস করার পরে প্রথমদিকে কয়েক বছর আসামের গৌহাটি শহরে একটি নামকরা কলেজে অধ্যাপনা করতেন। সেখানেই ওনার আলাপ হয়েছিল দেবীর সাথে। যার ভালো নাম ছিল দেবদত্তা। দেবদত্তা অসাধারণ মেধাবিনী,বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারিনী অনন্য ব্যক্তিত্বের একজন নারী ছিলেন। যার রূপ আর বুদ্ধিমত্তার কথা সবাই জানতেন। দেবদত্তা ছোটবেলা থেকেই প্রত্যেকটি পরীক্ষায় প্রথম হতেন। অসাধারণ বীণা বাজাতে পারতেন,আপন খেয়ালে রং তুলিতে ছবি আঁকতে পারতেন। আবার প্রত্যেকদিন ভোরবেলায় ব্রহ্মপুত্রে স্নান করে শিবের মাথায় জল ঢেলে শুক্লেশ্বর ঘাটে গিয়ে শিবের ধ্যান করতেন। অনেকে তাকে মা অন্নপূর্ণা বলেও ডাকত কারণ দেবদত্তা রন্ধন পটিয়সীও ছিলেন। একবার একটি মন্দিরে দেবতার ভোগ রান্না করার সময় ব্রাহ্মণ ঠাকুরটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে বহু লোকের ভোগ একা হাতে রান্না করেছিলেন। আর সেই অমৃত প্রসাদ খেয়ে চার পাশের লোকজন ওনার নাম দিয়েছিল অন্নপূর্ণা। তিনি কোন সাধারণ নারী হতে পারেননা। তার সাহসেরও কোন সীমা পরিসীমা ছিলনা। তাই ভর সন্ধ্যেবেলায়ও তিনি যেকোনো পাহাড়ি রাস্তা বা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একা একা শিবের যেকোন দুর্গম মন্দিরেই চলে যেতে পারতেন। দেবদত্তার এই বিস্ময়কর স্বভাব ওনাকে সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। যদিও তিনি সব সময় মানুষের আপদে বিপদে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন তবুও চারপাশের সাধারণ মানুষজন তার সাথে মিশতে বা কথা বলতে একটু হলেও সংকোচ করত বা ভয় পেতো কারণ সবাই এটাই মনে করত যে,দেবদত্তা কোন সাধারণ মেয়ে না। ও ঈশ্বরের মানষকন্যা। যাইহোক এতদূর বলে বন্যার ঠামু এবার চুপ করে গেলেন এবং ছল ছল চোখে বন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন “মা এবার আমি তোমাকে যে কথা বলব আমি জানি সেটা শুনলে তোমার মন অস্থির হয়ে উঠবে কিন্তু তবুও সত্যকে তোমার মোকাবিলা করতেই হবে। আর আমি চাইওনা যে তুমি চিরকাল একটা অর্ধ সত্যকে আঁকড়ে থাকো।”
এরপর ঠাকুমার কথাতেই বন্যা জানতে পারে যে,এই দেবদত্তার সাথেই ওর বাবা আদিত্য চৌধুরীর বিয়ে হয়েছিল আর বন্যা তাদেরই সন্তান। যুথিকা ওর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী আর শোধন যুথিকার সন্তান। এই শুনে বন্যা ছটফট করে ওঠে এবং ওর ঠাকুমাকে বলে “ঠামু তুমি এটা কি বলছ? আমার এই মা আমার মা নন? আমার মা অন্য একজন?তাহলে তিনি আমাকে ছেড়ে চলে গেয়েছিলেন কেন? তিনি কি আমাকে ভালবাসতেন না?” ঠাকুমা তখন বন্যাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলেন,না সোনা,সে তো সারা পৃথিবীকে ভালোবাসে আর তোমাকে ভালোবাসবে না এ কখনো হয়? আসলে কি জানো তো দিদিভাই,সে খুব কষ্ট পেয়ে,বড় অভিমানে সবকিছু ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তুমি একদম তারই মত হয়েছো তাইতো আমার তোমাকে নিয়ে এত ভয়,এত চিন্তা। সে যে তার সবচেয়ে বড় ধন আমার কাছেই রেখে গেছে যা আমি এতকাল বুক দিয়ে আগলে রেখেছি। আসলে কি জানো তো, সে মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত,তাই সে ভাবতো এই সংসারের সবাই বোধয় তারই মত হবে। কিন্তু আমরা তো সাধারণ মানুষ মা,সে যে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তোমার মা দেবী তোমার বাবা আদিত্যর থেকেও অনেক বেশি মেধাবী ছিল। প্রথমে অবশ্য তোমার বাবার তাকে ভালো লাগার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ ছিল কিন্তু পরে এটাই ওর পতনেরও কারণ হল। পুরুষ মানুষ তো,তাই বউকে সব দিক থেকে এগিয়ে যেতে দেখে মেনে নিতে পারেনি।
তাই ভেতরে ভেতরে একটা চাপা ক্ষোভ বা ঈর্ষা কাজ করত তার। তবে ওদের দুজনের মধ্যে খুব ভাব ভালবাসাও ছিল আর তাই তুমি তাদের ভালোবাসার ধন হয়ে এসেছ আমাদের পরিবারে। কিন্তু তোমার যখন মাত্র এক বছর বয়েস তখন তোমার মা আরো পড়াশোনা করার জন্য বিদেশে যেতে চেয়েছিল, হয়তো গবেষণা করবে বলে। আমি মুখ্য সুখ্যু মানুষ ঠিকমত সেসব বলতে পারব না। যাইহোক তোমার বাবা তাতে রাজি হয়নি তাই তোমার মা মনে বড় আঘাত পেয়েছিল। আমি কিন্তু শুনে বলেছিলাম ওকে যাবার অনুমতি দিতে কিন্তু আদিত্য আমার কথা শোনেনি। যাই হোক এই নিয়ে পরিবারের মধ্যে একটা চাপা অসন্তোষ শুরু হয়েগিয়েছিল কিন্তু তবুও সে তার রোজকার সব দায়িত্ব কর্তব্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো আর সারারাত জেগে মোটা মোটা বই নিয়ে মাটিতে বসে পড়াশোনা করতো আর যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তো তখন শিবের নাম জপ করতো। বাড়ির বউ আর সকলের মত নয় সবার থেকে আলাদা এটাই ওর কাল হল।
এমন সময় আবার একটা ভয়ংকর কাণ্ডও ঘটিয়ে বসলো সে। একদিন মধ্যরাতে কাউকে কিছু না বলে কয়েই শিবের টানে কিভাবে কে জানে স্টিমারে করে না লঞ্চে করে সে মাঝ ব্রহ্মপুত্রে শিবের মন্দির উমানন্দে চলে গিয়েছিল। এদিকে সকালবেলায় বাড়িসুদ্ধ লোক তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিল। তোমার বাবাও একেবারে পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। তুমিও ঘুম থেকে উঠে মা কে কাছে না পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিলে। কিছুতেই তোমাকে থামানো যাচ্ছিল না।এমন সময় তোমার বাবার কথায় কিছু লোক আশেপাশের শিব মন্দিরগুলো তে ওকে খুঁজতে যায়। আর এই ভাবেই ওদের মধ্যে থেকে কয়েকজন কি জানি কি মনে করে উমানন্দেও চলে গিয়েছিল।
আর সেখানে গিয়েই তারা তোমার মাকে খুঁজে পায়।
এরপর তোমার মা যখন বাড়িতে ফিরে আসে তখন তাকে নিয়ে চারপাশে সাংঘাতিক সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। চৌধুরীদের বাড়ির বউ কাল সারারাত নিরুদ্দেশ ছিল। তাকে কোথা না কোথা থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। কে জানে মন্দিরে আরো কেউ ছিল কিনা?
ইত্যাদি ইত্যাদি। এইভাবে তার চরিত্র নিয়ে চারপাশের লোকজন কু ইঙ্গিত করতে শুরু করে।আদিত্য ভালোভাবেই জানতো তোমার মা শিব টানে এমন অদ্ভুত কার্যকলাপ করে থাকে। কিন্তু তার পক্ষেও আর সেদিন তোমার মার চরিত্রের এই বিশালতা আর যোগিনী স্বভাবকে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই সে রাগের মাথায়,লোকের প্ররোচনাতেই তোমার মাকে অনেক কটু কথা বলে দেয়। এমনকি তোমার মার সাধের বীণা টাও আছাড় মেরে ভেঙে দেয়,তার সমস্ত মেডেল,বই পত্রও তছনছ করে দেয়।
তোমার মা এই এত বড় আঘাত সহ্য করতে পারেনি। তাই অপমানে,অভিমানে সে ঠাকুর ঘরে গিয়ে দরজা দিয়ে দেয়,আত্ম পক্ষ সমর্থনের জন্য একটা কথাও বলেনি। কিন্তু পরদিন ভোরবেলায় যখন সে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে,তখন তাকে দেখে আমরা সবাই আঁতকে উঠি। কারণ তার পরনে তখন ছিল গেরুয়া বসন,গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর বুকের কাছে শক্ত করে ধরে রাখা একটা শিবলিঙ্গ। তোমার বাবা ওর এই রূপ সহ্য করতে পারেনি তাই সে সব মান অভিমান ভুলে, দেবীর হাতেপায়ে ধরে ওকে আটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ততক্ষণে যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাকে যে এতটা অপমান করাই যায় না। আর করলে তো তার শাস্তি পেতেই হবে। তাইতো সারাটা জীবন ধরেই আমরা শাস্তি ভোগ করে যাচ্ছি। তাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারিনি এটাই কি কম শাস্তি? তুমি কি ভাবো তোমার বাবার মনে এই নিয়ে কোন অনুশোচনা নেই। আছে দিদিভাই আছে। কিন্তু কি করব তোমাকে একা হাতে সামলানো অত সোজা কাজ ছিল না। তাই কয়েক বছর বাদে আমরাই জোর করে তোমার বাবার বিয়ে দি যুথিকার সাথে। যুথিকা বড় ভালো মেয়ে সে কোনদিনও তোমাকে বুঝতেও দেয়নি যে তুমি তার পেটের সন্তান না। এই জন্যেই আমি ওকে এতটা ভালবাসি। ওর মনটাও খুব বড়। সে তোমার মার মত বিদূষী নারী না কিন্তু এতগুলো বছর ধরে সে আমাদের সবাইকে আগলে রেখেছে ভালবাসার বাঁধনে। এই বা কম কিসের? ” এই বলতে বলতে ঠাকুমা ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন,
” দেবী,দেবী,মা আমার কোথায় আছিস মা? তোর কি আমাদের কথা একবারও মনে পরেনা? তুই এত বড় শিব সাধিকা হয়ে গেছিস?”
বন্যা সব শুনে ব্যাকুল ভাবে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করে,” ঠাকুমা, মা এখন কোথায় আছে? কোথায় থাকতে পারে আমার মা? তোমরা কি তারপরে আমার মাকে আর কখনো খোঁজ নি?” লতিকা এর উত্তরে বলেন, “খুঁজেছিলাম কিন্তু কোন লাভ হয়নি। কারণ যে একবার সন্ন্যাস নিয়ে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যায় সে আর কখনো ফিরে আসেনা। তবে তোমার ছোটকা তাকে কিছুদিন আগে হরিদ্বারে গঙ্গার ঘাটে দেখেছিল। কে জানে সে এখন কোন পাহাড়ে বা কোন জঙ্গলে বসে শিবের ধ্যান করছে?” ঠামুর কাছে এই সব কথা শুনে বন্যা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,যেভাবেই হোক সে তার মাকে একদিন ঠিক খুঁজে বের করবে। আর একবারের জন্য হলেও সে সেই দেবী প্রতিমার দর্শন করবে।
এরপর দেখতে দেখতে বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। বন্যার ঠাকুমা লতিকা দেবী মারা গেছেন। শোধন একটা কলেজে এখন অধ্যাপনার কাজ করে তবে আদিত্য তা দেখে যেতে পারেননি কারণ তিনি অবসর নেওয়ার কয়েক মাস পরেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। যুথিকার শরীরটাও এখন আর বিশেষ ভালো থাকে না, তাও সে আজও একা হাতেই পুরো বাড়িটার দেখাশোনা করে। এবার হয়তো সে শোধনের বিয়েও দেবে।
শোনা যায় আদিত্য মারা যাওয়ার দিন, সেখানে নাকি ওঁর মৃতদেহের সামনে,কোথা থেকে কে জানে,একজন বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনী এসে উপস্থিত হয়েছিলেন আর সকলের চোখের নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়েও গিয়েছিলেন।
যাই হোক অন্যদিকে বন্যা সন্ন্যাস না নিলেও তার মায়ের আদর্শকে গ্রহণ করেই তার পুরো জীবনটা সঁপে দিয়েছে মানুষের সেবার কাজে।
একদিন শোধন কলেজ থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে এসে বেশ উত্তেজিত ভাবে যুথিকা কে ডাকতে থাকে। যুথিকা শোধনের এইভাবে ডাকাডাকি শুনে তাড়াতাড়ি ভেতর ঘর থেকে বায়রে বেরিয়ে আসেন। শোধন তখন উচ্ছ্বাসের সাথে যুথিকার সামনে তার হাতে মুড়ে রাখা খবরের কাগজটা মেলে ধরে।
যুথিকা দেখেন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় করে বন্যার ছবি বেরিয়েছে। সে আজ সারা ভারতের গরিব-দুখী,অত্যাচারিত,বঞ্চিত মানুষজনের কাছে তাদের আত্মার আত্মীয় ‘দেবিকা’। যে তাদের মঙ্গল সাধনের জন্য অষ্টপ্রহর অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আজ কোথাও তার প্রচেষ্টায় তৈরি হচ্ছে অনাথ আশ্রম কোথাও বা বৃদ্ধাশ্রম আবার কোথাও তার অদম্য জেদের জন্য দুর্গম কোন জায়গায় গড়ে উঠছে হাসপাতাল।
- অনেক বছর বাদে বন্যার ছবিটা এইভাবে দেখে খুব ভালো লাগে যুথিকার। সে খবরের কাগজটা তে বন্যার ছবির ওপরে হাত বোলাতে,বোলতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,” ভাল থাকিস মা যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস,ভালো ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুন।”